— রমা ভৌমিক
এই মুহূর্তে পৃথিবী আজ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। অভূতপূর্ব গভীর সংকটের এক মৃত্যু-শীতল ছায়া গোটা বিশ্বকে গ্রাস করেছে। মৃত্যুভয় আপামর বিশ্ববাসীকে করে তুলেছে দিশাহারা। করোনা নামে এক ভয়ংকর মারণ ভাইরাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বময়।বিশ্ব জুড়ে পরিত্রাহি রব উঠেছে, সভ্যতা আজ মৃত্যুর অতল গহবরের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে।।
কিন্তু যে মানুষ তার নিজের কবর নিজেরাই খুলেছে তাদের রক্ষা করবে কে? মহাভারতে আছে, দূর্যোধন, যুধিষ্ঠির সহ পঞ্চপান্ডব কে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করার জন্য যুদ্ধের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। শ্রীকৃষ্ণের দৌত্যকে ব্যর্থ করে বলেছে,” বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী”। অর্থাৎ যেন তেন প্রকারে যুদ্ধ চাইই চাই। তবে ভিতরে ভিতরে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বনবাসী সহায় সম্বলহীন পান্ডু পুত্রেরা শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণের ভরসায় এত বড় শক্তির সাথে যুদ্ধ করতে কখনোই সাহস দেখাবে না, এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার ভাবনা সরিয়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় দাবি-দাওয়া পরিত্যাগ করে পিছু হটবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব পক্ষ যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে কুরুক্ষেত্রে অবতীর্ণ হল তখন পিতা-পুত্রের টনক নড়ে উঠেছে, তখন শ্রীকৃষ্ণের কাছে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আর্জি জানিয়েছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে যুধিষ্ঠির আর যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়াতে চায়নি। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন, “মানব সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা নিজেদের ঘরে নিজেরাই আগুন লাগায় আর সেই আগুন যখন সবকিছুর সাথে তাদেরকে ও গ্রাস করতে উদ্যত হয় তখন বাঁচাও বাঁচাও বলে পরিত্রাহি রব তোলে। তাই কোনো অবস্থাতেই আজ দুর্যোধনকে সহানুভূতি দেখাতে চাইনা।”
আজকে পৃথিবীতে মারন ভাইরাস নিয়ে যে পরিত্রাহি রব উঠেছে তার কারণ যতই চীনের ষড়যন্ত্র হোক না কেন, মানব সভ্যতা যে ভাবে ভ্রান্ত পথ ধরে হাঁটছিল আজ না হোক কাল এমন টা ঘটতোই। হয়তো এক্ষেত্রে করনা ভাইরাস এই ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষ কারণ, কিন্তু এর পেছনে আরও বহুবিধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ ও বর্তমান। পৃথিবীতে দূষণ মাত্রা এমন একটা চরম জায়গায় পৌঁছেছে, অচিরেই সভ্যতা ধ্বংসকারী অন্য কোন সংকট পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তোই।
এমনটা তো হবারই ছিল । রাস্তা চওড়া করার নামে কোটি কোটি প্রাচীন বৃক্ষের নিদারুণ হত্যালীলা সংগঠিত হচ্ছিল, শুরু হয়েছিল বৃক্ষ নিধন উৎসব। বনাঞ্চল নিঃশেষ হয়ে চলছিল নির্বিচারে। পরশুরামের কুঠার অবলীলাক্রমে ছিন্নভিন্ন করছিল ধাত্রী জননীর হৃদয়কে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে, এর বিষময় পরিণামের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। করেছে মানব সভ্যতার সংকট নেমে আসার ভবিষ্যৎ বাণী। কিন্তু কোন কিছু তোয়াক্কা করেনি মুনাফালোভী হিংস্র শ্বাপদের দল। তাই যেটা হবার ছিল সেটাই হয়েছে।
আজএই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি না শেষ পর্যন্ত আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা পাবে কিনা, আমরা মারণ রোগ কে মারতে পারবো, না ,মারন ভাইরাস, আমাদের বিলুপ্তি ঘটাবে পৃথিবী থেকে। আমরা জানি না step-by-step আমরা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছি কিনা। পৃথিবীতে 5000 বছরের সভ্যতার প্রলয় ঘটবে কিনা। জানিনা এটাই পৃথিবীর অন্তিম মুহূর্ত কিনা।
পুরানে আছে পৃথিবীতে বহুবার মহাপ্রলয় ঘটেছে। আমরা ইতিহাসেও পড়েছি আদিম যুগ… প্রস্তর যুগ… তুষার যুগ… নব প্রস্তর যুগ।এভাবে প্রতিটি যুগের সন্ধিক্ষণে নেমে এসেছে মহাপ্রলয়, পুরনো সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ সুতরো করে দিয়ে গেছে। পরবর্তীকালে ভগ্ন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের উপরে গড়ে উঠেছে নতুন করে নতুন ভাবে ভিন্ন এক নতুন সভ্যতা। আজও কেউ বলতে পারেনি হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মত উন্নত সভ্যতা ধ্বংসের প্রকৃত নির্ভরযোগ্য কারণ। হয়তো বা মহাপ্রলয় ঘটেছিল পৃথিবীতে। সমস্ত রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় গুলো একসাথে নেমে এসেছিল, অতিবৃষ্টি ,-অনাবৃষ্টি -দুর্ভিক্ষ -মহামারী -সুনামি -ভূমিকম্প- আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, আকাশ থেকে বৃষ্টির ধারার মতো লক্ষ-কোটি উল্কাপাত অথবা অগ্নি বৃষ্টি আছড়ে পড়েছিল প্রাচীন সভ্যতার বুকে, হয়তো বা এরকম কোন এক ভাইরাসের আগমন ঘটেছিল, যার মোকাবেলা করা সম্ভব হয়নি। তবে একটা কথা একেবারে নির্ভেজাল সত্যি যা ই ঘটুক না কেন সবকিছুর মূলে ছিল বিশ্ব স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কিছু মানুষের অপরিণামদর্শিতা ।একজন মানুষ যখন অপরিমিত বলশালী হয়ে ওঠে তখন… সে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। শক্তির মদমত্ততা উন্মাদ করে তোলে তাদের।দানব শক্তির মধ্যস্থতায় সে তখন চায় স্বর্গ -মর্ত্য -পাতাল এর অধীশ্বর হতে। এখন একটা সুযোগ এসেছে পৃথিবীর কাছে, করোনা ভয়ঙ্কর নাগিনীর বিষাক্ত হলাহল কে প্রতিরোধ করার জন্য সমস্ত পৃথিবী আজ একত্রিত হয়েছে। দিন আনা দিন খাওয়া, লেখাপড়া না জানা মানুষরাও আজ এই বিষয়ে সচেতন। তারাও আজ নিজেদের কথা না ভেবে দূর দূর দেশের অচেনা অজানা মানুষের কথা ভাবছে, তারা বেঁচে থাকলে বা রক্ষা পেলে নিজেরাও রক্ষা পাবে, তারা নিরাপদে থাকলে সকলেরই নিরাপদ থাকার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে, একথা ভেবে। সমগ্র বিশ্ব আজ এক বিশাল রঙ্গমঞ্চে একসাথে দন্ডায়মান।প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর চূর্ণ করে অন্তর শক্তিকে জাগ্রত করে সকলে একযোগে একসাথে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সম্মিলিত মানব গোষ্ঠীর সামনে এখন একটাই লক্ষ। প্রত্যেকটি মানুষকে এই ভয়ঙ্কর ঘটনার কার্য -কারণ- পরিণাম, বিচার-বিশ্লেষণ করার, সমাজের অসুরদের সনাক্ত করার, এবং এই কাজে বর্তমান পৃথিবীর সংহত শক্তিকে কাজে লাগানোর কথা ভাবতে হবে। শুধু ভাবনা নয় এ কাজে প্রত্যেকের বাস্তব অংশগ্রহণ এবং প্রস্তাবিত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার দিকে দ্রুত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
শক্তি যদি মহৎ কাজে উৎসর্গ করা যায় তাহলে তা কল্যাণী শক্তির রূপ নেয় আর যদি রক্তলোলুপ চেঙ্গিস খাঁর মতো নির্মম অত্যাচারের বিধ্বংসী করাল রূপ দেখায় তখন তাকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হলো অশুভ শক্তিকে আরো মজবুত করে তোলা। তাই যেটুকু সময় আমাদের হাতে এখনো বেঁচে আছে তা অত্যন্ত মূল্যবান। তার সদ্ব্যবহার এর মধ্য দিয়ে সময়কে সার্থক করে তুলতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলার বিষপানে আত্মহত্যা করেছিল, আর করোনা যুদ্ধের অবসানের পর ও সমস্ত পৃথিবীকে যুদ্ধকালীন তৎপরতা বাঁচিয়ে রাখতে হবে, , অশুভ শক্তির নাশ, হিংসা প্রতিহিংসার চিরকালীন অবসান, শক্তির দম্ভ কে চিরদিনের মত স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য বিশ্বের সাথে একযোগে কাজ করে যেতে হবে, যাতে অপশক্তিগুলো আর কখনোই বিশ্বের কোন দেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে । দানব শক্তি যত বড় ভয়ঙ্কর হোক না কেন, রণচন্ডীর রণহুঙ্কারে তার হৃদয় প্রকম্পিত করবেেই। কালকূট বিষ যতই তীব্র হোক ধন্বন্তরি মত ওঝার পাল্লায় পড়লে উদ্যত ফনি মাথা নত করতে বাধ্য হবে।
আজকের অভিজ্ঞতা থেকে অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। নিজেকে পরিবারকে সমাজকে এক কথায় সমস্ত পৃথিবী কে বাঁচাতে সমস্ত পৃথিবী কে একত্রিত হয়ে অশুভ শক্তির সাথে মোকাবেলা করতে হবে। বন্যার জল নেমে গেলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়না বরং সমস্যা মোকাবেলায় তৎপর হতে হয় জল নেমে যাওয়ার পরেই।
বর্তমান পৃথিবী আজ বহুমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠেছে। অতীতের বহু শত শতাব্দীর সংকীর্ণতা স্বার্থপরতা লোভ-লালসার শিকার এযুগের মানুষ আমরা সর্বান্তকরণে উপলব্ধি করতে পেরেছি বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ভালোবাসার গুরুত্ব। সুযোগ পেয়েছি হৃদয়ের ভালোবাসাকে প্রবাহিত করে অন্যের হৃদয়ের দরজায় পৌঁছে যাওয়ার। তাই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত একসাথে একযোগে অংশগ্রহণ করেছে সমস্যা সমাধানের মোকাবেলা তে। অনুভব করেছে বিশ্বজনীন হৃদয় কে পারস্পরিক মেলবন্ধন এর উপযোগিতা কে।
একটা সময় আমরা জগতকে উপেক্ষা করে ঘরমুখী হয়ে পড়েছিলাম। এই অখন্ড অবসরে কেটে গেছে শত শত শতাব্দী। যুগান্তর ঘটে গেছে পৃথিবীতে, ঘটে গেছে কালান্তর। বারেবারে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে ক্রান্তিকাল। নিভে গেছে আলো, চারিদিক ঢাকা পড়ে গেছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে।
জাগ্রত চেতনায় উপলব্ধি করেছি ঘরের আলোর সীমাবদ্ধতার দিকটি। আত্মকেন্দ্রিকতার বিষময় পরিণাম। ভয়ঙ্কর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ আমাদের বাইরের খোলশটা ঝরে গেছে।
ভোর হচ্ছে, এক নতুন ভোর। আর অল্প দিনের মধ্যে পাল্টে যাবে সমস্ত পৃথিবীটা। আমরা থাকি আর না থাকি প্রকৃতিতে সুবাতাস বইবে, আলোর জোয়ারে ভেসে যাবে গোটা পৃথিবী। বিষাক্ত বাতাসের বিলুপ্তি ঘটবে, গাছে গাছে দোল খাবে ময়না টিয়া বুলবুলি দোয়েল পাখির ঝাঁক।
সকল বাধা বন্ধন ছিন্ন করে ফেলে হৃদয় মন আজ উন্মুখ হয়ে উঠেছে, এই নতুন ভোরে নতুনভাবে আমাদের জীবনকে, জীবনের প্রবাহকে নতুন ধারায় নতুন খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য, বিশ্ব-রঙ্গমঞ্চে সবার সাথে দাঁড়াতে সবার হাতে হাত মেলাতে। একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে ভরিয়ে তোলার আহ্বান এসেছে ।এতোটুকু স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে পারলে মিলবে উদার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রবেশের ছাড়পত্র। এতেই মিলবে মানব মুক্তি পথের সন্ধান।
তাই————
“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।
এই যে বিপুল ঢেউ লেগেছে
তোর মাঝেতে উঠুক মেতে,
সকল পরান দিকনা নাড়া।
বোস না ভ্রমর এই নীলিমায় আসন লয়ে
অরুণ আলোর স্বর্ণরেণু মাখা হয়ে।
যেখানেতে অগাধ ছুটি যেন সেটা তোর ডানা দুটি সবার মাঝে পাবি সারা।”
— রমা ভৌমিক
Rama di,
This is a wonderful write up. Your language beautifully captures the current global crisis. I hope you keep writing on an ongoing basis as it unfolds and wraps up!